দ্বাদশ শ্রেণি
বিষয়- রাষ্ট্রবিজ্ঞান
অধ্যায়- ভারতের শাসনবিভাগ
প্রশ্ন- অঙ্গরাজ্যের রাজ্যপালের ক্ষমতা ও পদমর্যাদা ব্যাখ্যা করো। [5+3]
উত্তর- ভারতীয় সংবিধানের 153 নং ধারা অনুযায়ী প্রত্যেক অঙ্গরাজ্যের জন্য একজন রাজ্যপাল থাকবেন (There shall be a Governor for each State)। তবে দুই বা তার বেশি রাজ্যের জন্যও একজন রাজ্যপাল থাকতে পারেন। রাজ্যপালগণ পাঁচ বছরের জন্য রাষ্ট্রপতি কর্তৃক নিযুক্ত হন। সংবিধান অনুসারে, রাজ্যপালদের কার্যকালের মেয়াদ নির্ভর করে রাষ্ট্রপতির সন্তুষ্টির উপর। অর্থাৎ, ভারতের রাষ্ট্রপতি কোনো অঙ্গরাজ্যের রাজ্যপালকে পাঁচ বছরের আগেই পদচ্যুত করতে পারেন, অথবা পাঁচ বছর পেরিয়ে যাওয়ার পরও ওই পদে তাকে পুনর্নিয়োগ করতে পারেন।
রাজ্যপালের ক্ষমতা
ভারতের অঙ্গরাজ্যগুলিতে কেন্দ্রের মতোই সংসদীয় শাসনব্যবস্থা প্রবর্তিত হয়েছে। অঙ্গরাজ্যের শাসনব্যবস্থায় রাজ্যপাল হলেন নিয়মতান্ত্রিক শাসক এবং মুখ্যমন্ত্রীর নেতৃত্বাধীন মন্ত্রিপরিষদ হল প্রকৃত শাসক। ভারতের সংবিধান অনুসারে রাজ্যপালের ক্ষমতাগুলি এইরকম-
1) শাসনসংক্রান্ত ক্ষমতা
i) সংবিধান অনুযায়ী, ভারতের অঙ্গরাজ্যগুলির শাসনক্ষমতা রাজ্যপালের হাতে অর্পণ করা হয়েছে। বলা হয়েছে, তিনি নিজে বা অধস্তন কর্মচারীর মাধ্যমে এইসব ক্ষমতা প্রয়োগ করতে পারবেন।
ii) রাজ্যের বিধানসভা নির্বাচনের পর সংখ্যাগরিষ্ঠ দলের নেতা বা নেত্রীকে রাজ্যপাল মুখ্যমন্ত্রী হিসেবে নিযুক্ত করেন এবং মুখ্যমন্ত্রীর পরামর্শক্রমে মন্ত্রিপরিষদের অন্যান্য সদস্যদের নিয়োগ করেন।
iii) তিনি মুখ্যমন্ত্রী সহ যেকোনো মন্ত্রীকে পদচ্যুত করতে পারেন।
iv) সংবিধানের 356 নম্বর ধারা অনুযায়ী তিনি রাষ্ট্রপতিকে সংশ্লিষ্ট রাজ্যে শাসনতান্ত্রিক অচলাবস্থা-জনিত জরুরি অবস্থা ঘোষণার জন্য সুপারিশ করতে পারেন।
v) রাজ্যের শাসনসংক্রান্ত যেকোনো বিষয়ে রাজ্যপালকে অবহিত রাখা মুখ্যমন্ত্রীর কর্তব্য।
vi) রাজ্যপালগণ সংশ্লিষ্ট রাজ্যে অবস্থিত বিশ্ববিদ্যালয়গুলির (কেন্দ্রীয় বিশ্ববিদ্যালয় ব্যতীত) আচার্য বা চ্যান্সেলরের ভূমিকা পালন করে থাকেন।
2) আইনসংক্রান্ত ক্ষমতা
i) রাজ্য আইনসভা কর্তৃক গৃহীত কোনো বিলে রাজ্যপাল সম্মতি দেওয়ার পর সেটি আইনে পরিণত হয়।
ii) বিশেষ ধরনের কিছু বিলে তিনি নিজে সম্মতি না দিয়ে রাষ্ট্রপতির বিবেচনার জন্য প্রেরণ করতে পারেন।
iii) কোনো বিল যদি হাইকোর্টের মর্যাদাহানিকর বলে মনে হয়, তবে সেই বিল তিনি রাষ্ট্রপতির বিবেচনার জন্য পাঠাতে বাধ্য থাকেন।
iv) বিধানসভা নির্বাচনের পর এবং প্রতিবছর রাজ্য আইনসভার প্রথম অধিবেশনে তিনি ভাষণ দিতে পারেন
v) কোনো বিল সম্পর্কে আলোচনা চলাকালীন তিনি বাণী (Message) প্রেরণ করতে পারেন।
vi) যেসব রাজ্যের আইনসভা দ্বিকক্ষবিশিষ্ট সেখানে উচ্চকক্ষে অর্থাৎ বিধান পরিষদে তিনি সাহিত্য, বিজ্ঞান, শিল্পকলা প্রভৃতি বিষয়ে পারদর্শী কয়েকজন ব্যক্তিকে মনোনীত করতে পারেন।
3) অর্থসংক্রান্ত ক্ষমতা
i) রাজ্যপালের সম্মতি ছাড়া রাজ্য আইনসভায় অর্থবিল উত্থাপন করা যায় না।
ii) তিনি অর্থমন্ত্রীর মারফত বার্ষিক আয়-ব্যয়ের বিবরণ বাজেট পেশ করেন।
iii) রাজ্যের আকস্মিক ব্যয় তহবিলের দায়িত্বভার রাজ্যপালের হাতে ন্যস্ত থাকে।
4) বিচারসংক্রান্ত ক্ষমতা
i) রাজ্যপালের পরামর্শক্রমে রাষ্ট্রপতি হাইকোর্টের বিচারপতিদের নিয়োগ করে থাকেন।
ii) রাজ্যপাল রাজ্যের দেওয়ানী আদালতের বিচারপতি, অতিরিক্ত জেলা জজ প্রমুখকে নিয়োগ করেন এবং তাদের বদলি, পদোন্নতি ইত্যাদি বিষয়ে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতে পারেন।
iii) রাজ্যপাল আইনভঙ্গের অপরাধে দন্ডপ্রাপ্ত ব্যক্তির দণ্ডাদেশ হ্রাস বা স্থগিত করতে পারেন। তিনি মৃত্যুদণ্ড ছাড়া অন্যান্য দণ্ডপ্রাপ্ত অপরাধীকে ক্ষমাও প্রদর্শন করতে পারেন।
5) স্বেচ্ছাধীন ক্ষমতা
রাজ্যপালের স্বেচ্ছাধীন ক্ষমতা হল সেই সব ক্ষমতা যেগুলি প্রয়োগ করার জন্য তাকে মন্ত্রিসভার পরামর্শ নিতে হয় না। যেসব ক্ষেত্রে রাজ্যপাল তার স্বেচ্ছাধীন ক্ষমতা প্রয়োগ করতে পারবেন সেগুলি হল-
i) কোনো রাজ্যপাল যখন সংশ্লিষ্ট রাজ্যের পার্শ্ববর্তী কেন্দ্রশাসিত অঞ্চলের প্রশাসক হিসাবে নিযুক্ত হন তখন সেই অঞ্চলের শাসনকার্য পরিচালনার ব্যাপারে তিনি স্বেচ্ছাধীন ক্ষমতা প্রয়োগ করতে পারবেন।
ii) রাষ্ট্রপতি যদি মহারাষ্ট্র এবং গুজরাটের কয়েকটি অঞ্চলের উন্নতি বিধানের জন্য স্বতন্ত্র উন্নয়ন পর্ষদ গঠনের দায়িত্ব রাজ্যপালের হাতে অর্পণ করেন, তাহলে রাজ্যপাল এব্যাপারে স্বেচ্ছাধীনভাবে কাজ করতে পারেন না।
iii) নাগাল্যান্ড, সিকিম, মনিপুর এবং অরুণাচল প্রদেশের রাজ্যপালগণ সংশ্লিষ্ট রাজ্যের আইন-শৃঙ্খলা বজায় রাখার জন্য যেসব ব্যবস্থা গ্রহণ করবেন, সেসব ক্ষেত্রে তারা স্ববিবেচনা অনুযায়ী কাজ করতে পারবেন।
iv) অসমের উপজাতি অধ্যুষিত এলাকায় কতকগুলি নির্দিষ্ট প্রশাসনিক বিষয়ে এবং অসম ও তার স্বয়ংশাসিত জেলা পরিষদের মধ্যে খনিজ সম্পদের লভ্যাংশ বণ্টনের বিষয়ে কোনো বিরোধ দেখা দিলে সেক্ষেত্রে অসমের রাজ্যপাল স্বেচ্ছাধীন ক্ষমতা প্রয়োগ করতে পারেন।
রাজ্যপালের পদমর্যাদা
রাজ্যপালের পদমর্যাদা নিয়ে পণ্ডিতদের মধ্যে মতবিরোধ রয়েছে। অনেকের মতে ভারতের অঙ্গরাজ্যগুলির রাজ্যপালগণ প্রকৃত শাসক, আবার অনেকের মতে তারা নিয়মতান্ত্রিক শাসক হিসেবে ভূমিকা পালন করেন। নিয়মতান্ত্রিক শাসক হিসেবে রাজ্যপালের ক্ষমতা রাষ্ট্রপতির মতোই সীমিত। যেমন, সংবিধান অনুযায়ী রাজ্যের সমস্ত শাসনক্ষমতা রাজ্যপালের হাতে অর্পণ করা হলেও প্রকৃত ক্ষমতা ভোগ করে মুখ্যমন্ত্রীর নেতৃত্বাধীন মন্ত্রিপরিষদ। আইন প্রণয়নের ক্ষেত্রেও রাজ্যপালের ভূমিকা বিশেষ তাৎপর্যপূর্ণ নয়। অঙ্গরাজ্যের শাসনব্যবস্থায় রাজ্যপালের তাৎপর্যহীন ভূমিকা প্রসঙ্গে সরোজিনী নাইডু একসময় বলেছিলেন রাজ্যপাল হলেন "সোনার খাঁচায় বন্দি পাখি"।
তবে অনেকেই রাজ্যপালকে নিয়মতান্ত্রিক শাসক বলার বিরোধী। রাজ্যপালকে প্রকৃত শাসক বলার পিছনে যুক্তিগুলি হল-
(i) সংবিধান অনুসারে রাজ্যপাল হলেন রাজ্যের প্রকৃত শাসককর্তা। প্রয়োজন হলে তিনি মন্ত্রিসভার পরামর্শ ও সাহায্য গ্রহণ করতে পারেন, আবার নাও পারেন।
(ii) সংবিধানে রাজ্যপালকে যে সকল স্বেচ্ছাধীন ক্ষমতা দেওয়া হয়েছে সেগুলি প্রয়োগ করার জন্য মন্ত্রিসভার পরামর্শ নিতে হয় না এবং এই ক্ষমতা প্রয়োগের বৈধতা সম্পর্কে আদালতে প্রশ্নও তোলা যায় না। এইভাবে স্বেচ্ছাধীন ক্ষমতা প্রয়োগ করে রাজ্যপাল প্রকৃত শাসক হিসেবে আত্মপ্রকাশ করতে পারেন।
(iii) বিধানসভা নির্বাচনে কোনো দল সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করতে না পারলে রাজ্যপাল নিজের বিবেচনা অনুযায়ী মুখ্যমন্ত্রী নিয়োগ করতে পারেন।
(iv) রাজ্যপাল প্রেরিত প্রতিবেদনের মাধ্যমে রাষ্ট্রপতি কোনো রাজ্যে শাসনতান্ত্রিক অচলাবস্থাজনিত জরুরি অবস্থা বা রাষ্ট্রপতি শাসন জারি করতে পারেন। এইভাবে তিনি রাজ্যের মন্ত্রিসভাকে ক্ষমতাচ্যুত করতে পারেন।
(v) রাজ্য আইনসভা রাজ্যপালকে নিয়োগ করে না এবং তাকে পদচ্যুতও করতে পারে না। রাজ্যপাল হলেন রাষ্ট্রপতির প্রতিনিধি। সুতরাং রাজ্য সরকারের প্রতি তার অনুগত থাকার প্রয়োজন হয়না।
পরিশেষে বলা যায়, ভারতের অঙ্গরাজ্যগুলির রাজ্যপালগণ পুরোপুরি নিয়মতান্ত্রিক শাসক নন, আবার তাকে প্রকৃত শাসকও বলা চলে না। বরং বলা ভালো, রাজ্যপাল হলেন সংবিধান-প্রদত্ত বিশেষ ক্ষমতাসম্পন্ন নিয়মতান্ত্রিক শাসক।